কালেমা বা কালিমা (আরবি: ٱلكَلِمَات) ইসলামের মৌলিক বিশ্বাস সংবলিত কয়েকটি আরবি পংক্তির নাম। এর মাধ্যমেই ইসলামের প্রথম স্তম্ভ শাহাদাহ্ পূর্ণতা পায়। ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ — আল্লাহ ছাড়া কোনো সত্য মাবুদ বা উপাস্য নেই। এটি ইসলামের চূড়ান্ত কালেমা, মানবজীবনের পরম বাক্য।
এই মহামূল্যবান বাণীর রয়েছে বিশেষ মর্যাদা এবং এর সাথে সম্পর্ক রয়েছে বিভিন্ন হুকুম আহকামের। আর এই কালেমার রয়েছে এক বিশেষ অর্থ ও উদ্দেশ্য এবং কয়েকটি শর্ত, ফলে এ কালেমাকে গতানুগতিক মুখে উচ্চারণ করাই ঈমানের জন্য যথেষ্ট নয়। বান্দার প্রথম কাজ হলো এ কালেমার স্বীকৃতি দান করা; কেননা এ হলো সমস্ত কর্মের মূল ভিত্তি। ইসলামে মোট ছয়টি কালেমা রয়েছে।
পাঁচ কালেমা কি? এই কালেমা জানা কি মুসলিমের জন্য জরুরী?
কালেমা তাইয়্যেবা
কালেমা তাইয়্যেবা ইসলামের মূল ঘােষণা। এই কালেমা না পড়ে কোনাে মানুষই ইসলামের সীমার মধ্যে প্রবেশ করতে পারে না। এ জন্যই কোনাে কাফের অথবা মুশরিক ব্যক্তি যখন ইসলাম কবুল করতে চায়, তখন সর্বপ্রথমই তাকে এই কালেমা পড়তে হয়। মুসলমানদের ঘরে কোনাে সন্তানের জন্ম হলে তার কানে সর্বপ্রথম এই কালেমার আওয়াজ শােনানাে হয়।
মুসলমানদের মহল্লায় মহল্লায় দিন-রাতের মধ্যে পাঁচ বার মুয়াজ্জিন এই কালেমা উচ্চৈঃস্বরে ঘােষণা করে সকলকে নামাযের দিকে আহ্বান জানায়। নামাযের মধ্যে এই কালেমা বারবার পড়তে হয়। কুরআন শরীফের পাতায় পাতায় এই কালেমার কথা নানাভাবে লেখা আছে। ইসলামে কালেমার গুরুত্ব যে কতখানি, এর দ্বারাই তা বুঝতে পারা যায়। অতএব প্রত্যেকটি মুসলমানের পক্ষেই এই কালেমার অর্থ খুব ভালাে করে জেনে নেওয়া দরকার।
কালেমা তাইয়্যেবা আরবী উচ্চারণ:
لَآ اِلَهَ اِلَّا اللهُ مُحَمَّدٌ رَّسُوْلُ اللهِ
কালেমা তাইয়্যেবা বাংলা উচ্চারণঃ লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ।
কালেমা তাইয়্যেবা বাংলা অর্থঃ আল্লাহ ছাড়া কোন মা’বুদ নাই, মুহাম্মাদ (সাঃ) আল্লাহর রাসুল।
কালেমা তাইয়্যেবা ফজিলত
حَدَّثَنَا عَبْدُ الْحَمِيدِ بْنُ بَيَانٍ الْوَاسِطِيُّ، حَدَّثَنَا خَالِدُ بْنُ عَبْدِ اللَّهِ، عَنْ يُونُسَ، عَنْ حُمَيْدِ بْنِ هِلاَلٍ، عَنْ هِصَّانَ بْنِ الْكَاهِلِ، عَنْ عَبْدِ الرَّحْمَنِ بْنِ سَمُرَةَ عَنْ مُعَاذِ بْنِ جَبَلٍ، قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ ـ صلى الله عليه وسلم ـ “ مَا مِنْ نَفْسٍ تَمُوتُ تَشْهَدُ أَنْ لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللَّهُ وَأَنِّي رَسُولُ اللَّهِ ـ صلى الله عليه وسلم ـ يَرْجِعُ ذَلِكَ إِلَى قَلْبٍ مُوقِنٍ إِلاَّ غَفَرَ اللَّهُ لَهَا ” .
আবদুল হামীদ ইবন বায়ান ওয়াসিতী (র)……মুঁআয ইবন জাবাল (রা) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা) বলেছেনঃ যে কোন ব্যক্তি একবার সাক্ষ্য দিয়ে মৃত্যুবরণ করলে যে আল্লাহ ছাড়া আর কোন ইলাহ নেই এবং আমি আল্লাহর রাসুল, আর উক্ত সাক্ষ্য বিশ্বাসী হৃদয়ের দিকে প্রত্যবর্তন করবে (অর্থাৎ খালিস দিলে এ সাক্ষ্য দিবে) আল্লাহ অবশ্যই তাকে মাগফিরাত দান করবেন।
ইবনে মাজাহ-৩৭৯৬
কালেমায়ে শাহাদাত
ইসলামের ৫টি ভিত্তি রয়েছে সেগুলোর মধ্যে কালিমা শাহাদাত হলো পঞ্চ ভিত্তির অন্যতম একটি ভিত্তি। ইমান বা বিশ্বাসের মূল কথা হলো এই কালিমা। কালিমা শাহাদাতের পুরো অর্থ হচ্ছে সাক্ষ্য বাণী।
কালিমা শাহাদাতে একটি সাক্ষ্যই দেয়া হয় সেটা হচ্ছে “আল্লাহ ব্যতীত আর কোনো মাবুদ নাই, তিনি এক ও একক, তাঁর কোনো শরিক বা অংশীদার নাই; আর নিশ্চয়ই হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহ তায়ালার অতি প্রিয় বান্দা ও তাঁর প্রেরিত রাসুল।”
এই সাক্ষ্য শুধু মুখে নয়, মনে প্রাণে শুদ্ধভাবে নিয়ত করে স্বীকার করতে হবে।
কালিমা শাহাদাত ফারসি এবং আরবি দুটো ভাষাতেই রয়েছে। ফারসি উচ্চারন হবে ‘কালেমায়ে শাহাদাত’, আর আরবিতে হবে ‘কালেমাহ শাহাদাত’ বা ‘আল কালিমাতুশ শাহাদাত’।
কালেমা শাহাদাত আরবি উচ্চারণ:
اَشْهَدُ اَنْ لَّآ اِلَهَ اِلَّا اللَّهُ وَحْدَهُ لَا شَرِيْكَلَهُ وَاَشْهَدُ اَنَّ مُحَمَّدًا عَبْدُهُ وَرَسُوْلُهُ
কালেমা শাহাদাত বাংলা উচ্চারণ: আশহাদু আল লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াহদাহু লা-শারীকালাহু ওয়া আশহাদু আন্না মুহাম্মাদান আবদুহু ওয়া রাসুলুহ্।
কালেমা শাহাদাত বাংলা অর্থ: আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ছাড়া কোন মা’বুদ নাই। তিনি এক। তাঁর কোন অংশীদার নাই, এবং আমি আরও সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, মুহাম্মদ (সাঃ) আল্লাহর বান্দা এবং তাঁর প্রেরিত রাসুল।
কালেমা শাহাদাত ইংরেজি উচ্চারণঃ Ashahado An Laa ilaaha illal Laho Wahdahoo Laa Shareeka Lahoo Wa Ash Hado Anna Mohammadan Abdo Hoo Wa Rasoolohoo.
কালেমা শাহাদাত ফজিলত
যখন মুসলমানরা নামায পড়ে তখন অবশ্যই অজু করতে হয়। আর এই অজু করার জন্য সওয়াব প্রাপ্তি হয় এবং অজু শেষে কালেমা শাহাদাত পাঠে বান্দার আমলনামায় যুক্ত হয় অতিরিক্ত একটি সওয়াব।
কেউ যদি নিয়মিত অজু করে কালেমা শাহাদাত পাঠ করে তাহলে পরকালে বান্দার জন্য জান্নাতের আটটি দরজাই খুলে দেওয়া হবে।
হজরত ওমর ইবনে খাত্তাব (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সাঃ) ইরশাদ করেছেনঃ
‘তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি সব নিয়ম-কানুনসহ উত্তমরূপে অজু করবে এবং শেষে কালেমা শাহাদাত পাঠ করবে, তার জন্য জান্নাতের আটটি দরজাই খুলে দেওয়া হবে। সে যে দরজা দিয়ে ইচ্ছা প্রবেশ করতে পারবে।’
– (মুসলিম : ২৩৪)
আল্লাহ তায়ালা অতি সহজ এই আমলটি নিয়মিত করার এবং এই ফজিলত অর্জনের তওফিক দান করুন।
কালেমা তাওহীদ
কালেমা তাওহীদ আরবী উচ্চারণ:
لَآ اِلَهَ اِلَّا اَنْتَ وَاحِدًا لَّا ثَانِيَ لَكَ مُحَمَّدٌ رَّسُوْلُ اللهِ اِمَامُ الْمُتَّقِيْنَ رَسُوْلُ رَبِّ الْعَلَمِيْنَ
কালেমা তাওহীদ বাংলা উচ্চারণঃ লা-ইলাহা ইল্লা আনতা ওয়াহিদাল লা ছানীয়া লাকা মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহি ইমামুল মুত্তাকীনা রাসুলু রাব্বিল আলামীন।
কালেমা তাওহীদ বাংলা অর্থঃ তুমি (আল্লাহ) ছাড়া অন্য কোন উপাস্য নেই। তুমি এক, তোমার দ্বিতীয় কেউ নেই। আল্লাহর রাসুল মুহাম্মাদ (সাঃ) আল্লাহভীরুদের নেতা ও বিশ্বপ্রতিপালকের রাসূল।
কালেমা তামজীদ
কালেমা তামজীদ আরবী উচ্চারণ:
لَآ اِلَهَ اِلَّا اَنْتَ نُوْرًا يَّهْدِيَ اللهُ لِنُوْرِهِ مَنْ يَّشَاءُ مُحَمَّدٌ رَّسُوْلُ اللهِ اِمَامُ الْمُرْسَلِيْنَ خَاتَمُ النَّبِيِّيْنَ
কালেমা তামজীদ বাংলা উচ্চারণঃ লা-ইলাহা ইল্লা আনতা নূ-রাই ইয়াহদিয়াল্লাহু লিনূরিহী মাই-ইয়াশাউ মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহি ইমামুল মুরসালীনা খাতামুন নাবিয়্যীন।
কালেমা তামজীদ বাংলা অর্থঃ তুমি (আল্লাহ) ছাড়া অন্য কোন উপাস্য নেই। তুমি জ্যোতির্ময়, যাকে ইচ্ছা হয় তাকেই তোমার নূর দ্বারা পথ প্রদর্শণ কর। মুহাম্মাদ (সাঃ) আল্লাহর রাসুল, রাসুলগণের নেতা এবং সর্বশেষ নবী।
কালেমা রদ্দে কুফর
কালেমা রদ্দে কুফর আরবী উচ্চারণ:
اَللَّهُمَّ اِنِّىْ اَعُوْذُ بِكَ مِنْ اَنْ اُشْرِكَ بِكَ شَيْئًا وَّاَنَا اَعْلَمُ بِهِ وَاَسْتَغْفِرُكَ لِمَا اَعْلَمُ بِهِ وَمَا لَآ اَعْلَمُ بِهِ تُبْتُ عَنْهُ وَتَبَرَّاْتُ مِنَ الْكُفْرِ وَالشِّرْكِ وَالْمَعَاصِيْ كُلِّهَآ وَاَسْلَمْتُ وَاَمَنْتُ وَاَقُوْلُ اَنْ لَّآ اِلَهَ اِلَّا اللهُ مُحَمَّدٌ رَّسُوْلُ اللهِ
বাংলা উচ্চারণঃ আল্লাহুম্মা ইন্নী আউযুবিকা মিন আন উশরিকা বিকা শাইআওঁ ওয়া আনা আ’লামু বিহী ওয়া আস্তাগফিরুকা লিমা আ’লামু বিহী ওয়ামা লা-আ’লামু বিহী তুবতু আনহু ওয়া তাবাররা’তু মিনাল কুফরি ওয়াশ শিরকি ওয়াল মাআছি কুল্লিহা ওয়া আসলামতু ওয়া আমানতু ওয়া আকুলু আল লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ।
বাংলা অর্থঃ হে আল্লাহ! আমি তােমারই দরবারে আশ্রয় চাচ্ছি। আমি যেন কাউকেও তােমার সাথে অংশীদার সাব্যস্ত না করি। আমার জ্ঞানের সীমারেখার ভিতরের ও বাইরের সকল প্রকার পাপ থেকে ক্ষমা প্রার্থনা করছি এবং তা থেকে তওবা করছি। সকল প্রকার কুফর, শিরক ও যাবতীয় গুনাহ থেকে নিজেকে মুক্ত ঘােষণা করছি এবং ঈমান ও ইসলামকে মেনে নিচ্ছি। আর স্বীকারােক্তি দিচ্ছি যে, নিশ্চয়ই আল্লাহ্ তায়ালা ব্যতীত আর কোন উপাস্য নেই। মুহাম্মদ (সাঃ) আল্লাহর রাসূল।
ঈমান-ই-মুজমাল
ঈমান-ই-মুজমাল আরবী উচ্চারণ:
اَمَنْتُ بِاللهِ كَمَا هُوَ بِاَسْمَائِهِ وَصِفَاتِهِ وَقَبِلْتُ جَمِيْعَ اَحْكَامِهِ وَاَرْكَانِهِ
ঈমান-ই-মুজমাল বাংলা উচ্চারণঃ আমানতু বিল্লাহি কামা হুয়া বিআসমায়িহী ওয়া ছিফাতিহী ওয়া কাবিলতু জামী’আ আহকামিহী ওয়া আরকানিহ্।
ঈমান-ই-মুজমাল বাংলা অর্থঃ আমি আল্লাহ তা’আলার উপর ঈমান আনলাম, যেমন তিনি তাঁর নাম এবং গুণাবলীর উপর অধিষ্ঠিত এবং আমি গ্রহণ করেছি তার সমস্ত হুকুম-আহকাম ও বিধি-বিধান।
ঈমান-ই-মুফাসসাল
ঈমান-ই-মুফাসসাল আরবী উচ্চারণ:
اَمَنْتُ بِاللهِ وَمَلَئِكَتِهِ وَكُتُبِهِ وَرَسُلِهِ وَالْيَوْمِ الْاَخِرِ وَالْقَدْرِ خَيْرِهِ وَشَرِّهِ مِنَ اللهِ تَعَالَى وَالْبَعْثِ بَعْدَ الْمَوْتِ
ঈমান-ই-মুফাসসাল বাংলা উচ্চারণঃ আমানতু বিল্লাহি ওয়া মালায়িকাতিহী ওয়া কুতুবিহী ওয়া রুসূলিহী ওয়াল ইয়াউমিল আখিরি ওয়াল ক্বাদরি খাইরিহী ওয়া শাররিহী মিনাল্লাহি তা’আলা ওয়াল বা’ছি বা’দাল মাওত।
ঈমান-ই-মুফাসসাল বাংলা অর্থঃ আমি ঈমান আনলাম আল্লাহর উপর তাঁর ফেরেশতাদের উপর, তাঁর আসমানী কিতাবসমূহ, তাঁর রাসূলগণ এবং শেষ দিবসের উপর আর এর উপর যে, অদৃষ্টের ভাল-মন্দ আল্লাহ তা’আলার তরফ হতে এবং মৃত্যুর পর পুনরুত্থানের উপর।
বিঃদ্রঃ কালেমায়ে তাইয়্যেবাহ্ হচ্ছে পবিত্র বাক্য, কালেমায়ে শাহাদাত হচ্ছে সাক্ষ্য বাক্য, কালেমায়ে তাওহীদ হচ্ছে একত্ববাদ বাক্য, কালেমায়ে তামজীদ হচ্ছে গুণবাক্য, কালেমায়ে রদ্দে কুফর হচ্ছে কুফরী হতে বিরত হবার বাক্য।